আইন পরামর্শ: বাংলাদেশে জমি কেনার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলী ও সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া
বাংলাদেশে জমি কেনা একটি বড় বিনিয়োগ, যা সঠিক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই সম্পন্ন করতে হয়। নিচে জমি কেনার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলী, সম্পূর্ণ ধাপসমূহ এবং এ বিষয়ে প্রযোজ্য আইন ও সাংবিধানিক বিধান আলোচনা করা হলো।
বাংলাদেশে জমি কেনার শর্তাবলী
ক্রেতার যোগ্যতা:
- বাংলাদেশি নাগরিক হওয়া আবশ্যক:
- বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪২ অনুযায়ী, বাংলাদেশের নাগরিকদের সম্পত্তি অধিকার সংরক্ষিত।
- বিদেশিরা শুধুমাত্র জমি লিজ নিতে পারেন, কিনতে পারেন না।
- মালিকানার সঠিকতা যাচাই:
- জমির মালিকের নাম সঠিক কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। এটি ট্রান্সফার অফ প্রোপার্টি অ্যাক্ট, ১৮৮২-এর ধারা ৭ অনুযায়ী পরিচালিত হয়, যেখানে বলা হয়েছে যে শুধুমাত্র প্রকৃত মালিকই সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন।
- জমির প্রকার ও ব্যবহার:
- জমি কৃষি, বাণিজ্যিক বা আবাসিক, কোন ধরণের তা নিশ্চিত করতে হবে। জমির ব্যবহার পরিবর্তন প্রয়োজন হলে, এটি স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
- জমি বিবাদমুক্ত কিনা তা নিশ্চিত করা:
- জমি কোন প্রকার বিরোধ, বন্ধক বা আইনগত জটিলতা থেকে মুক্ত কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় ভূমি অফিস থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (NOC) সংগ্রহ করে এটি যাচাই করা সম্ভব।
বাংলাদেশে জমি কেনার ধাপসমূহ
ধাপ ১: মালিকানা ও ভূমি রেকর্ড যাচাই
- নিম্নোক্ত দলিলের সঠিক কপি সংগ্রহ করতে হবে:
- খতিয়ান (রেকর্ড অফ রাইটস): এটি স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০ অনুযায়ী সংরক্ষিত।
- মিউটেশন সার্টিফিকেট: মালিকানার প্রমাণপত্র।
- টাইটেল ডিড (সত্ত্ব দলিল): খতিয়ানের সাথে দলিল মিলিয়ে দেখতে হবে।
- বায়া ডিড (মালিকানার ধারাবাহিক দলিল): কমপক্ষে ২৫ বছরের মালিকানার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে।
ধাপ ২: ভূমি জরিপ করা
- জমির সীমানা যাচাই করতে এবং কোন অবৈধ দখল আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে শারীরিকভাবে জমি জরিপ করতে হবে।
- দলিলে উল্লেখিত জমির পরিমাণ ও মাপ সঠিক কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে।
ধাপ ৩: জমির বিরোধমুক্ত সনদ সংগ্রহ করা
- সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে এনকাম্ব্রেন্স সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হবে, যা জমি বন্ধক বা আইনগত জটিলতা মুক্ত কিনা তা নিশ্চিত করবে।
ধাপ ৪: বিক্রয় চুক্তি প্রস্তুত ও সম্পাদন করা
- একটি লিখিত চুক্তি (বায়নাপত্র) প্রস্তুত করতে হবে, যেখানে থাকবে:
- ক্রেতা ও বিক্রেতার নাম।
- জমির বিবরণ।
- বিক্রয় মূল্য ও অর্থ পরিশোধের শর্তাবলী।
- বিক্রয় সম্পন্ন করার সময়সীমা।
ধাপ ৫: অগ্রিম অর্থ প্রদান
- জমির মোট মূল্যের একটি অংশ অগ্রিম প্রদান করতে হবে এবং এটি বিক্রয় চুক্তিতে উল্লেখ করতে হবে। অগ্রিম অর্থ প্রদানের জন্য সঠিক রসিদ সংগ্রহ নিশ্চিত করতে হবে।
ধাপ ৬: স্ট্যাম্প ডিউটি ও ট্যাক্স পরিশোধ করা
- স্থানীয় ট্রেজারি অফিসে স্ট্যাম্প ডিউটি (১.৫% থেকে ৪.৫%) এবং রেজিস্ট্রেশন ফি (সাধারণত জমির মূল্যের ১%) পরিশোধ করতে হবে।
- ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৪ অনুযায়ী প্রযোজ্য কর যেমন ক্যাপিটাল গেইনস ট্যাক্স এবং ভ্যাট প্রদান করতে হবে।
ধাপ ৭: জমি নিবন্ধন করা
- বিক্রয় চুক্তি, টাইটেল ডিড এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দলিল সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে জমা দিয়ে জমি নিবন্ধন করতে হবে, যা রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৯০৮ অনুযায়ী সম্পন্ন হবে।
- নিবন্ধনের পর নিবন্ধিত দলিল সংগ্রহ করতে হবে।
ধাপ ৮: মিউটেশন সম্পন্ন করা
- সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে মিউটেশন সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে হবে। এটি সরকারি রেকর্ডে ক্রেতার নাম অন্তর্ভুক্ত করতে অপরিহার্য।
ধাপ ৯: জমির দখল গ্রহণ
- সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরে জমির দখল গ্রহণ করতে হবে।
প্রাসঙ্গিক আইন ও বিধানসমূহ
- বাংলাদেশের সংবিধান:
- অনুচ্ছেদ ৪২: সম্পত্তির অধিকার।
- ট্রান্সফার অফ প্রোপার্টি অ্যাক্ট, ১৮৮২:
- ধারা ৭: সম্পত্তি হস্তান্তরের অধিকার।
- স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০:
- ভূমি মালিকানা ও ভাড়াটিয়া সংক্রান্ত বিধান।
- রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৯০৮:
- সম্পত্তি নিবন্ধন সংক্রান্ত বিধান।
- ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৪:
- জমি কেনার কর সংক্রান্ত বিধান।
গ্রন্থপঞ্জি
- The Constitution of the People’s Republic of Bangladesh.
- The Transfer of Property Act, 1882.
- The State Acquisition and Tenancy Act, 1950.
- The Registration Act, 1908.
- The Income Tax Ordinance, 1984.
প্রস্তুত করেছেন:
দীপঙ্কর বিশ্বাস
শিক্ষানবিশ আইনজীবী ও আইন পরামর্শদাতা
ইমেইল: dipankaronline444@gmail.com