প্রাচীনতম ধর্মীয় সম্প্রদায়: হিন্দুধর্ম ও আদিম প্রকৃতিপূজা

প্রাচীনতম ধর্মীয় সম্প্রদায়: হিন্দুধর্ম ও আদিম প্রকৃতিপূজা

কোন ধর্মীয় সম্প্রদায় প্রাচীনতম ধর্মীয় সম্প্রদায়?

প্রাচীনতম ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে বেশ কয়েকটি ধর্ম ও আচার-অনুষ্ঠানের শেকড় অনুসন্ধান করতে হয়, যাদের শুরু হয়েছিল মানব সভ্যতার আদিকালেই। মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাসের বিকাশের সাথে সাথে ধর্মীয় ধারণাগুলোর বিকাশ ঘটেছে। এ বিষয়ে সাধারণত দুটি প্রধান মত প্রচলিত রয়েছে—একটি হলো হিন্দুধর্ম এবং অন্যটি হলো আদিম প্রকৃতিপূজা বা টোটেমিজম।

১. হিন্দুধর্ম

হিন্দুধর্মকে প্রাচীনতম সংগঠিত ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটির শেকড় ৪০০০ বছরেরও বেশি পুরোনো এবং এটি ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত হয়েছে। হিন্দুধর্মে কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রবর্তক নেই, বরং এটি দীর্ঘ সময় ধরে সংস্কৃতি ও চিন্তার বিবর্তনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে। হিন্দুধর্মের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ হলো বেদ (বিশেষ করে ঋগ্বেদ), যা প্রাচীনতম ধর্মীয় সাহিত্য হিসেবে পরিচিত। ঋগ্বেদ প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচিত, যেখানে দেবতা, আচার-অনুষ্ঠান এবং উপাসনার বিষয়ে বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এই ধর্মগ্রন্থে দেবতা ও মহাশক্তিগুলোর উপাসনা এবং ধ্যানের বিবরণ রয়েছে যা প্রাচীন হিন্দুধর্মের মূল দর্শন গঠনে সাহায্য করেছে। [সূত্র: হিন্দু রিলিজিয়ন অ্যান্ড ফিলসফি]

হিন্দুধর্মের বৈশিষ্ট্য হলো এটির বহুবিধতার প্রতি উদারতা এবং বহুদেবতার উপাসনা। এই ধর্মে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবের মতো দেবতাদের পূজা করা হয় এবং এটি বহু গ্রন্থ ও আচারভিত্তিক। ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, এবং অথর্ববেদ এই প্রাচীন গ্রন্থগুলো এই ধর্মের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। [সূত্র: দ্য বেদাস: অ্যান এনসাইক্লোপিডিয়া অব আর্লি ইন্ডিয়ান রিলিজিয়ন]

২. আদিম ধর্মবিশ্বাস

হিন্দুধর্মের পূর্বে এবং এর পাশাপাশি, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে আদিম ধর্মবিশ্বাস প্রচলিত ছিল। আদিম ধর্মবিশ্বাসের মূল ভিত্তি ছিল প্রকৃতিপূজা, টোটেমিজম, অ্যানিমিজম, এবং পূর্বপুরুষ পূজা। এই বিশ্বাসের মূল দর্শন ছিল প্রকৃতি এবং প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির প্রতি শ্রদ্ধা এবং উপাসনা। আদিম ধর্মবিশ্বাস কোনো নির্দিষ্ট গ্রন্থ বা প্রতিষ্ঠিত আচার-অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং এটি ছিল মানব সমাজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও দৈনন্দিন জীবনের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত।

টোটেমিজম বা টোটেম ধর্মের ধারণা ছিল বিভিন্ন প্রজাতি বা প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীকী পূজা, যা মূলত নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত হতো। একইভাবে, অ্যানিমিজম ধারণা অনুযায়ী প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান যেমন—গাছ, নদী, পাহাড় এবং পশুপাখি—একটি আত্মা বা জীবনশক্তি ধারণ করে। এই ধর্মবিশ্বাসের মাধ্যমে আদিম মানবসমাজে মানুষ প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের প্রতি শ্রদ্ধা ও সংযোগের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। [সূত্র: অ্যানিমিজম অ্যান্ড দ্য অরিজিন অব রিলিজিয়ন]

আদিম ধর্মবিশ্বাসের উদাহরণ আমরা আফ্রিকার বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী সম্প্রদায় এবং আমেরিকার বিভিন্ন নেটিভ আমেরিকান গোষ্ঠীর মধ্যে দেখতে পাই, যাদের মধ্যে আজও প্রকৃতিপূজার আচার পালন করা হয়। এ ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানগুলি ধর্মীয় গ্রন্থ, সংগঠিত আচার বা নির্দিষ্ট মন্দির ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল নয় বরং এটি প্রকৃতি, পূর্বপুরুষ এবং দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন প্রতীকী কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। [সূত্র: প্রিমিটিভ কালচার]

সুতরাং, যদিও হিন্দুধর্মকে প্রাচীনতম সংগঠিত ধর্ম হিসেবে ধরা হয়, আদিম ধর্মবিশ্বাস মানবজাতির আদিকাল থেকেই প্রচলিত ছিল এবং এটি আমাদের চিন্তা ও বিশ্বাসের বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

প্রাপ্তিস্বীকার:

১. হিন্দু রিলিজিয়ন অ্যান্ড ফিলসফি - হিন্দুধর্মের প্রাচীন ইতিহাস এবং এর বিকাশের ওপর বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে, যা দেখায় কীভাবে এই ধর্মের ভিত্তি গড়ে উঠেছে এবং এর আচার-অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্য আজও ধরে রেখেছে।

২. দ্য বেদাস: অ্যান এনসাইক্লোপিডিয়া অব আর্লি ইন্ডিয়ান রিলিজিয়ন - বেদ এবং অন্যান্য প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থগুলোর সংক্ষিপ্তসার ও ব্যাখ্যা প্রদান করে, যা হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে এবং এর প্রাচীন গ্রন্থগুলোর ওপর আলোকপাত করেছে।

৩. অ্যানিমিজম অ্যান্ড দ্য অরিজিন অব রিলিজিয়ন - এই গ্রন্থে প্রকৃতিপূজা ও অ্যানিমিজমের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে, যা আদিম ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত এবং প্রকৃতির উপাদানগুলোর আত্মিক দিক তুলে ধরে।

৪. প্রিমিটিভ কালচার - প্রাচীন বা আদিম সংস্কৃতির ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারের ওপর বিশদ আলোচনা করে, যা প্রকৃতিপূজা, পূর্বপুরুষ পূজা, এবং টোটেমিজমের মতো প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মানব সমাজের প্রাচীন বিশ্বাসকে তুলে ধরে।

এই উৎসগুলো প্রাচীনতম ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাস, হিন্দুধর্মের বিকাশ, এবং আদিম ধর্মবিশ্বাসের প্রকৃতিগত দিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে।

Post a Comment

Previous Post Next Post